ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এক জনপদ ময়মনসিংহ

১৭৮৭ সালের ১ মে জেলা প্রতিষ্ঠার পর জেলা শহর হিসাবে বর্তমান ময়সনসিংহ শহরের গোড়াপত্তন হয়। এর আগে যদিও বেগুনবাড়ীর কোম্পানী কুঠিতে অথবা বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে কাচারী বসত। কিন্তু কুঠি ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে বিলীন হলে শহরের উত্তর অংশে খাগডহরে কাচারী স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। নদের ভাঙনের কারণে সেই উদ্যোগ ভেস্তে গেলে (বর্তমান) কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুরের দক্ষিণে কাওনা নদীর তীরে প্রাচীন বাণিজ্য কেন্দ্র ‘দগদগা’ নামক স্থানে জেলা শহর স্থাপনের প্রস্তাব করে তৎকালীন ইংরেজ শাসকরা।
এতে এতদাঞ্চলের জমিদাররা আপত্তি করলে সেহড়া মৌজায় নাসিরাবাদ নাম দিয়ে জেলা শহরের পত্তন হয় ১৭৯১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের পুত্র নাসির উদ্দিন আবুল মোজাফফর নসরত শাহের নামানুসারেই নাম হয় নসরতশাহী এবং এতদাঞ্চলের শাসন কেন্দ্রের নাম দেয়া হয় নাসিরাবাদ। বর্তমান শহরে নাসিরাবাদের কোন চিহ্ন পর্যন্ত নেই। ব্রহ্মপুত্র নদের গর্ভে বিলীন হয়েছে নাসিরাবাদ। সেই স্মৃতিকে স্মরণ করেই জেলা শহর স্থাপনের সময় জেলা সদরের নামকরণ করা হয় নাসিরাবাদ। অবশ্য নামটি এখন আর চালু নেই।

ময়মনসিংহ অঞ্চলের ঐতিহাসিক নিদর্শন বইয়ের লেখক দরজি আবদুল ওয়াহাব উল্লেখ করেন যে, ‘শহর স্থাপনের পর মিউনিসিপালিটির নামও হয় নাসিরাবাদ মিউনিসিপ্যালিটি (জুলাই/১৮৫৮)। তৎকালীন বঙ্গদেশের মধ্যে স্থাপিত এটি প্রথম এবং উপমহাদেশের মধ্যে দ্বিতীয় পৌরসভা।’ এখানে উল্লেখ্য, পৌরসভার কাগজপত্র অনুসারে পৌরসভা স্থাপনের তারিখ ৮ই এপ্রিল ১৮৬৯। প্রথমদিকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পদাধিকার বলে পৌরসভার সভাপতি হন। এই পৌরসভার প্রথম অফিসিয়াল চেয়ারম্যান ছিলেন মি. আরপর্চা। প্রথম নন-অফিসিয়াল চেয়ারম্যান হন চন্দ্রকান্ত ঘোষ (১৮৮৬ সালে)। পৌরসভা গঠনের দীর্ঘ একশ’ দশ বছর পর প্রথম মুসলমান চেয়ারম্যান পদে আসীন হন খানবাহাদুর গিয়াস উদ্দিন পাঠান (১৯৪৮ সালে)। তিনি বর্তমান জেলার গফরগাঁও উপজেলামুখী গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। পৌরসভার প্রথম ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন ও এস স্ট্যাক ১৮৬৯ সালে। প্রথম হিন্দু ভাইস চেয়ারম্যান চন্দ্রকান্ত ঘোষ (১৮৮৪ সালে)। প্রথম মুসলমান ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন খানসাহেব সাহেব আলী (১৯১২ সালে)। তার নামানুসারে শহরের নতুন বাজার এলাকায় একটি সড়ক রয়েছে। ১৯১০ সালে পৌরসভার প্রথম নিজস্ব পাকা একতলা অফিস ভবন নির্মিত হয়। যা এখন জরাজীর্ণ অবস্থায় অফিসিয়াল কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।

১৯০৫ সালে নাসিরাবাদ পৌরসভার নাম পরিবর্তিত হয়ে ময়মনসিংহ পৌরসভা হয়। এই পরিবর্তনের পেছনে একাধিক কৌতূহলজনক ঘটনা রয়েছে। ঐতিহাসিকদের মতে, মেসার্স বর্জন লাল এন্ড কোং কর্তৃক রেলপথে নাসিরাবাদ পৌরসভার নিকট ২০ টিন কেরোসিন চালান দিলে তা মালবাবুর ভুলের জন্য রাজপুতানায় অবস্থিত নাসিরাবাদ নামক অন্য এক রেলস্টেশনে চলে যায়। মালবাবু নাকি রেলের রশিদে ময়মনসিংহ জেলার কথা উল্লেখ না করায় এমটা ঘটে। পৌর কর্তৃপক্ষকে সেই মাল ফিরিয়ে আনতে ৪৫ টাকা ১২ আনা মাশুল বেশি পরিশোধ করতে হয়। একই ভুলের কারণে জীবাণুতত্ত্ব¡বিদ কর্তৃক পৌরসভার নিকট আগরটিউবের আর একটি চালান পাঠালে সেটিও একইভাবে রাজপুতানায় চলে যায়। মালবাবুর এহেন ভুলের খেসারত দেয়ার জন্য পৌর কর্তৃপক্ষ বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে ১৯০৪ সালে ১৮ নবেম্বর পৌরসভাসহ রেলস্টেশন ও পোস্ট অফিসের নাম পরিবর্তন করে ময়মনসিংহ রাখার প্রস্তাব (জেলার নাম) দেন। যা ১৯০৫ সালের ১০ মার্চ তারিখে সরকারের ১২৯০-এম নং পত্রে প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। সেই থেকেই ময়মনসিংহ জেলা, রেলস্টেশন, পোস্ট অফিস এবং পৌরসভার নামকরণ হয়।
সেকালের শহর: শহরের গোড়াপত্তনকালে কোন প্রকার প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন না থাকলেও শহর গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ‘একটি সুন্দর আবাসিক ও শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে’। তৎসময়ে শহরের পুরাতাত্বিক গুরুত্ব কম থাকলেও এতদাঞ্চলের যা কিছু আধুনিকায়ন তার সবকিছু শহরকেন্দ্রিক। এজন্য শহরের গুরুত্ব যেমন অপরিসীম, তেমনি স্থান নির্বাচনের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। এই শহরের স্থান যখন নির্বাচন করা হয় তখন এটি ছিল নেহাত একটি সাধারণ গ্রাম। যার কোনো বাণিজ্যিক গুরুত্বও ছিল না।

ব্রহ্মপুত্র নদের তীরসহ গ্রামের অধিকাংশ এলাকা ছিল বন-জঙ্গলে ভরা। জনবসতি বলতে যা ছিল, তারা থাকত নদের তীর থেকে কিছু দূরে। বর্তমান শহরের যে স্থানে বড় বাজার, ছোট বাজার অবস্থিত। সেখানে নদের তীর ঘেঁষে একটি ছোট হাটের স্থান ছিল। নাম ছিল আলম বাজার। এই আলম বাজারকে ঘিরেই পরবর্তীতে গড়ে উঠে বড় বাজার, ছোট বাজার। এসব বাজারের ফাঁকে ফাঁকে ধীরে ধীরে সরকারী কর্মচারী, ব্যবসায়ী, উকিল, মোক্তার, কবিরাজ, কর্মকার ও স্বর্ণকারসহ প্রভৃতি পেশাজীবীরা আশ্রয় গড়ে তোলে। এসব স্থানের অদূরেই জঙ্গলের মধ্যে ছিল মুসলমান কৃষকদের বসতি।
বর্তমান সাহেব কোয়ার্টার এলাকায় দু’চারটি ঘরে বসবাস করত উপজাতি মান্দাইরা।  এসব বসতি জেলা সদরের জন্য নির্বাচিত করা হলে তৎকালীন অধিবাসীগণ স্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হন। তারা চলে যান অন্যত্র। তৎকালীন শহরের পশ্চিমদিকে জেলখানা থেকে পূর্বে পাঁচগোদাম এলাকা পর্যন্ত নদের তীরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ঝোঁপ-ঝাড়-খাল-খন্দক।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top