কতটা সংকটে ভারতীয় বিমানবাহিনী?

২৬ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার। গভীর রাত শেষে ঠিক ভোর হওয়ার আগে, রাত সাড়ে ৩টায় ভারতীয় বিমানবাহিনীর মিরেজ ২০০০ যুদ্ধবিমান লাইন অব কন্ট্রোল (এলওসি) অতিক্রম করে পাকিস্তানি ভূখন্ডে প্রবেশ করে আজাদ কাশ্মিরের বালাকোট জেলার জাবা নামক এলাকার পাহাড়ি অঞ্চলে হামলা করে। মিরেজ ২০০০ মডেলের যুদ্ধবিমানটি ফ্রান্স নির্মিত চতুর্থ প্রজন্মের একক ইঞ্জিনবিশিষ্ট যুদ্ধবিমান। হামলার সময় ভারতীয় বিমানবাহিনীর এই যুদ্ধবিমানটি বহন করছিল ‘স্পাইস-২০০০’ মডেলের ক্ষেপণাস্ত্র। আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য এবং জিপিএস নিয়ন্ত্রিত এই ক্ষেপণাস্ত্রটি ইসরাইলের হাতে তৈরি।

আধুনিক যুদ্ধবিমান ও অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে হামলা করতে যাওয়ার পরও ভারতীয় বিমানবাহিনী কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু বা কোনো কৌশলগত লক্ষ্যবস্তুতেও আঘাত করতে সক্ষম হয়নি। ভারতের আসন্ন সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে নরেন্দ্র মোদির প্রচারণার সুবিধার্থে লোক দেখানো কাজ হিসেবে এই হামলা করা হয়।

কেবল নিজের ব্যক্তিগত নির্বাচনী প্রচারণার সুবিধার্থে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশের একজন চরমপন্থী রাজনীতিবিদ সমগ্র ভারতীয় বিমানবাহিনীকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। ভারতীয় বিমানবাহিনীর সক্রিয় সেনা সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার এবং এর যুদ্ধবিমান সংখ্যা এক হাজার ৭২৪টি।

কিন্তু পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী ভারতীয় কৌশলকে পরাস্ত করে দুটি বিজয় অর্জন করেছেন- একটি ভারতের বিপক্ষে নৈতিক বিজয়, আর অন্যটি সামরিক বিজয়(পাকিস্তানি আকাশসীমায় দুটি ভারতীয় যুদ্ধবিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করার মাধ্যমে)।

যুদ্ধ সামগ্রিকভাবে একটি ভয়ঙ্কর ব্যয়বহুল ‘ব্যবসা’। ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান ভারতীয় ঘাঁটি থেকে উড়ে এসে পাকিস্তানের আজাদ কাশ্মিরের বালাকোট জেলার পার্বত্য-ঘেরা বন জঙ্গলে হামলা করে আবার ভারত ফিরে গেল। আজাদ কাশ্মিরের বালাকোট জেলায় ভারতীয় বিমানবাহিনীর এক একটি হামলা বা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের পিছনে খরচ হয়েছে প্রায় ১১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। মাত্র ৩০ মিনিট স্থায়ী এই অভিযানে ভারতীয় বিমানবাহিনী প্রায় ২০০ কোটি রুপি খরচ করেছে।

মনে রাখতে হবে, ভারতের মোট জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশ মানুষ প্রতিদিন ২ মার্কিন ডলার বা তারও কম আয় করে জীবনযাপন করে। কিন্তু তা হলে কি হবে! ভারতের বার্ষিক সামরিক বাজেট ফুলে ফেঁপে হয়েছে ৬ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। অন্যদিকে ভারতের বার্ষিক বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে হয়েছে ২০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার।

ভারতীয় বিমানবাহিনীর সক্রিয় সেনা রয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার। এদের মধ্যে পাঁচটি অপারেশনাল কমান্ড ও দুইটি ফাংশনাল কমান্ড। তাছাড়া দেশটির বিমানবাহিনীর রয়েছে ৬৬টি স্টেশন এবং আনুমানিক এক হাজার ৭২৪টি যুদ্ধবিমান।

কার্নেইজ এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস কতৃক ২০১৬ সালে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়,‘সংখ্যাগত দিক বিবেচনায় ভারতীয় বিমানবাহিনীকে যতটা শক্তিশালী মনে হয়, বাস্তবিক অর্থে ২০১৬ সালের প্রথমভাগ পর্যন্ত তারা এর থেকে দুর্বল। দেশটির বিমানবাহিনীর ৩৬.৫ শতাংশ নামমাত্র স্কোয়াড্রন এবং বিমানবাহিনীর সামনের সারির অনেক যুদ্ধবিমান পুরান ও সেকেলে।’

এই রিপোর্টে আরো বলা হয়,‘ত্রুটিপূর্ণ কাঠামো ভারতীয় বিমানবাহিনীর শক্তি ক্ষয়ের অন্যতম কারণ। ত্রুটিপূর্ণ কাঠামোর পাশাপাশি দুর্বল মানোন্নয়ন কর্মসূচী ভারতীয় বিমানবাহিনীকে হুমকির মুখে ফেলেছে। অপরদিকে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলো এই সেক্টরে দ্রুত আধুনিকায়ক করতে সক্ষম হয়েছে।’

কার্নেইজ’র রিপোর্ট অনুযায়ী, হালকা, মধ্যম ও ভারী যুদ্ধবিমান- এই তিন ক্ষেত্রেই ভারতীয় বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলো সমস্যার মধ্যে আছে। ২০১৮ সালে ‘ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট’ নামে আমেরিকান দ্বিমাসিক ম্যাগাজিন একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। যার শিরোনাম ছিল ‘কেন ভারতের বিমানবাহিনী মারা যাচ্ছে’। এই রিপোর্টে বলা হয়, ভারতে সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের বিষয়টি গভীরভাবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আবদ্ধ। যার ফলে আধুনিক সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে দেশটির বিমানবাহিনীতে অদক্ষতা ও অকার্যকারিতার সৃষ্টি হচ্ছে।

ভারতীয় বিমানবাহিনীতে থাকা রাশিয়া নির্মিত মিগ যুদ্ধবিমানগুলো এখন ‘উড়ন্ত কফিন’ বা ‘বিধবা বানানোর মেশিন’ হিসেবে পরিচিত। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘ভারতীয় বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলো কেন আকাশ থেকে পড়ে যাচ্ছে’। আশ্চর্য হলেও সত্য, রাশিয়ার নিকট থেকে ভারত ৮৭২টি মিগ যুদ্ধবিমান ক্রয় করে। এরমধ্যে অর্ধেকেরও বেশি যুদ্ধবিমান বিভিন্ন হামলা ও দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়েছে। অন্যদিকে ভারত নির্মিত যুদ্ধবিমানগুলো দেশটির বিমানবাহিনীর পাইলটদের জন্য একটা বড় হতাশার কারণ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।

ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ এন্ড অ্যানালাইসিস উইং (আরএডব্লিউ) এর সাবেক প্রধান এএস দুলাত বলছেন, সামনে এগিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় মাধ্যম হচ্ছে পাকিস্তানের সাথে সংলাপে বসা। যেকোনো মূলে ভারতকে আগ্রাসী মনোভাব পরিহার করতে হবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহরী বাজপেয়ী কাশ্মির নীতি মেনে চলেছেন, এখনও নয়াদিল্লীর উচিত সেটাই মেনে চলা। পাশাপাশি কাশ্মির ইস্যুতে দেয়া পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের ৪ দফা প্রস্তাব বা ফরমূলা খুবই বাস্তবিক। আমরা যদি তখন সেই প্রস্তাব বা ফরমূলা গ্রহণ করতাম, তাহলে গত ১৫ বছরে আমরা একটি শান্তির কাশ্মির পেতাম।

গত ৪ মার্চ নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়,‘পাকিস্তানের সাথে আকাশযুদ্ধে ভারতের পরাজয়ের পর ভারতের ‘সেকেলে’ সামরিকবাহিনী নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। গত পাঁচ দশকের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রথমবারের মতো এই আকাশযুদ্ধ হয়। এটা ভারতীয় সামরিকবাহিনীর জন্য ছিল খুবই দুর্লভ একটা পরীক্ষা। সন্দেহ নেই যুদ্ধের ফলাফলে ভারতীয় সামরিকবাহিনী হতবাক হয়ে গেছে।’

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে উদ্দেশ্য করে ভারতীয় বিমানবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত পাইলট রাজীব ত্যাগী বলেন,‘আমাদের সেনাদের রক্ত নিয়ে খেলা বন্ধ করুন।’ সূত্র: দ্য নিউজ।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top