গরীবের হার্ট এ্যাটাক হলে করণীয় : লেখাটি পড়লে বেঁচে যাবে হাজারো প্রাণ

গরীবের হার্ট এ্যাটাক এবং তার চিকিৎসা সম্পর্কে লিখেছেন-
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মাহবুবর রহমান
সিনিয়র কনসালট্যান্ট, ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট

পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত মৃত্যুর এক নম্বর কারণ হল হার্ট এ্যাটাক। এর ভয়াবহতা শুধু সর্বোচ্চ সংখ্যায় নয়, বরং অবিশ্বাস্য দ্রুততায় মূল্যবান জীবনকে কেড়ে নেওয়ার মধ্যেও। মৃত্যুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ হল ক্যান্সার। কিন্তু ক্যান্সারের উপসর্গ ধীরলয়ে প্রকাশ পায় , অনেক ক্ষেত্রে তা কয়েক বছরও লেগে যায়। ফলে রোগী এবং পরিবারকে তা মোকাবেলায় সময় দেয় এবং ধৈর্য্যশক্তি অর্জনে সুযোগ দেয়। কিন্তু হার্ট এ্যাটাক হলো টর্নেডোর মত। কখন শুরু হল, কখন শেষ হল তা বুঝে ওঠার আগেই সবকিছু তছনছ হয়ে যেতে পারে। এজন্যই হার্ট এ্যাটাকের আগাম পূর্বাভাস ও দুর্যোগ মোকাবেলায় বিশেষ দক্ষতা অর্জন গুরুত্বপূর্ণ ।

হার্ট এ্যাটাকের কারণ:

হার্ট বা হৃদপিন্ড হল শরীরের কেন্দ্রীয় পাম্প বা সেচ মেশিন। সারা শরীরে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত ও খাদ্য সরবরাহ করাই তার প্রধান কাজ। কোটি কোটি বিশেষভাবে তৈরী মাংসপেশির জাল দিয়ে হৃদপিন্ড গঠিত। যেহেতু আজীবন তাকে সংকোচন প্রসারণ করে পাম্পের কাজটি করতে হয় সেহেতু তার নিজস্ব মাংসপেশির জন্যও প্রয়োজন হয় অক্সিজেন ও খাদ্য। আর এই অক্সিজেন ও খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করে হার্টের তিনটি প্রধান ধমনী (coronary artery)। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই তিনটি ধমনীর যেকোন একটির দেয়াল ফেটে গিয়ে রক্ত জমাট বেঁধে ধমনীটি বন্ধ বা ব্লক হয়ে যেতে পারে। হঠাৎ করে হৃদপিন্ডের একটি বড় এলাকার মাংসপেশি মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ে। এর নামই হার্ট এ্যাটাক।

কারণের পেছনে কারণ:

এই যে বলা হল ধমনীর দেয়াল ফেটে রক্ত জমাট বাঁধার কথা সেটা তো বিনা কারণে হয় না। প্রধানত চারটি ঝুঁকি এজন্য দায়ী। ধূমপান, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও রক্তে অতি মাত্রায় কোলেস্টেরল বা চর্বির উপস্থিতি। তবে ব্যায়াম না করে অলস জীবন যাপন, অতিরিক্ত ওজন, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, মাদকদ্রব্য গ্রহন, বংশগত কারণও এজন্য দায়ী হতে পারে। এইসব ঝুঁকি এককভাবে বা সম্মিলিতভাবে রক্তনালীর দেয়াল নষ্ট করে ফেলতে পারে। একটি খসখসে দেয়ালে সহজে ময়লা জমে। ময়লার ভেতর বাজে চর্বি (oxidized lipids) ঢুকে একটি প্রদাহ (inflammation) সৃষ্টি করে। প্রদাহ সীমা ছাড়িয়ে গেলে ধমনীর দেয়াল ফেটে যায়। ফাটা দেয়ালে তখন রক্তের অনুচক্রিকা(platelets) একত্রিত হতে শুরু করে। শরীর মনে করে তার একটি রক্তনালী ছিঁড়ে গেছে তাই সেটি মেরামত করা দরকার। তখন রক্তের জমাট বাঁধা পদ্ধতি (coagulation system ) সক্রিয় হয়। সেখান থেকে ফিব্রিন বা তন্তু তৈরী হয়। এই তন্তু ও অনুচক্রিকা মিলে রক্তের একটি দলা (clot) তৈরী করে খুব দ্রুত ধমনীটিকে বন্ধ বা ব্লক করে দেয়। ফলে হৃদপিন্ডের ঐ অংশটুকু অক্সিজেন ও খাদ্যশূন্য হয়ে ধ্বংসের মুখোমুখি হয়। বন্ধ হওয়ার ১২ ঘন্টার মধ্যে ব্লক খুলে দিতে না পারলে হৃদপিন্ডের ঐ এলাকার মাংসপেশি অনিবার্য মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এটাই হল হার্ট এ্যাটাক।

হার্ট এ্যাটাকে অসুবিধা কি?

বুঝলাম একটি ধমনী বন্ধ হয়ে গেছে। তাতে কি কি সমস্যা হতে পারে? মনে রাখতে হবে হার্টের পাম্পিং ক্ষমতার উপর পুরো শরীরের ভাল থাকা নির্ভরশীল। স্বাভাবিক পাম্পিং ক্ষমতা ব্যাহত হলে শরীর অক্সিজেন ও খাদ্য থেকে বঞ্চিত হবে। শরীর দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে হতে চলাফেরা ও স্বাভাবিক জীবনের কার্যক্রম হারিয়ে ফেলবে। তবে আশু এবং প্রকট সমস্যা যেটা হতে পারে তা হল হার্টের বৈদ্যুতিক গোলযোগ (arrhythmias) এবং পাম্প ফেইল্যুর। হার্ট হঠাৎ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আমরা বলি Cardiac arrest বা sudden cardiac death! হার্ট এ্যাটাকে যত মৃত্যু হয় তার অধিকাংশ হয় প্রথম ২৪ ঘন্টায় এবং ২৫% মৃত্যু হাসপাতালে পৌঁছানোর পূর্বেই ঘটে থাকে।

করণীয় কি?

মূল কাজটি হল বন্ধ ধমনীটি খুলে দেয়া। এবং তা যত দ্রুত খুলে দেয়া যায় তত মংগল। মনে রাখতে হবে বন্ধ ধমনীর এলাকায় (territory) প্রতি মিনিটে লক্ষ লক্ষ মাংসপেশি ধ্বংস হচ্ছে। দু’মিনিট বেশি বন্ধ থাকলে তার দ্বিগুন মাংসপেশি মরে যাচ্ছে। এজন্য আমরা বলি minute means muscle! সময়ই এখানে সবকিছুর নিয়ামক ও ফলাফল নির্ধারক। এই বিষয়টি চিকিৎসক ও রোগী বা রোগীর লোকজনকে বুঝতে হবে, মানতে হবে। মূল্যবান সময় পার হয়ে গেলে যতই আধুনিক উন্নত চিকিৎসা দিই না কেন তাতে তেমন কোন লাভ হবে না। কারণ যে পেশিগুলোর মৃত্যু হল তাতে জগতের কেউ পুনর্জীবন দান করতে পারবেন না। এটাই জীববিদ্যা, জীবনের নিয়ম।

রোগীর করণীয় কি?

তিরিশ বছরের বেশি কোন ব্যক্তির যদি হঠাৎ তীব্র ব্যথা বুক বা তার আশপাশে অনুভূত হয়, ঘাম দেয়, বমি বা বমির ভাব হয় তাহলে দেরি না করে চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব একটি ইসিজি করাতে হবে। সেটা অবশ্যই ডাক্তার দিয়ে সাথে সাথে রিপোর্ট করাতে হবে। সকালের ইসিজি বিকেলে রিপোর্ট করালে চলবে না। এজন্য হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ভাল জায়গা।
রোগী যদি সচেতন শিক্ষিত হন তাহলে কিছু চিকিৎসা বাড়িতে বসেই শুরু করতে পারেন। প্রথমেই শান্ত হয়ে বসতে বা শুয়ে থাকতে হবে। ভ্যান, রিকসা, গাড়ি বা এ্যাম্বুলেন্স যাই হোক কল করতে হবে। সময়ক্ষেপণ করা চলবে না। রাতে ব্যথা হলে “সকাল পর্যন্ত দেখি” নীতি বর্জন করতে হবে। “যখনই ব্যথা তখনই হাসপাতাল “ নীতি গ্রহন করতে হবে।

যানবাহন আসার পূর্বেই যদি সম্ভব হয়:

১। একটি ডিসপ্রিন (Disprin) ট্যাবলেট ৩০০ মিগ্রাম চুষে বা পানিতে গুলে খেয়ে ফেলুন।
২। যদি হাতের কাছে ওষুধের দোকান থাকে তাহলে ৪টি ৭৫ মিগ্রাম Lopirel ট্যাবলেট খেয়ে ফেলুন।
৩।একটি Atova ৪০ মিগ্রাম ট্যাবলেট খেয়ে ফেলুন।
৪। গ্যাসের সমস্যা মোকাবিলায় একটি Pantonix ৪০ মিগ্রাম ট্যাবলেট খেয়ে ফেলুন।

চিকিৎসকের করণীয়: বন্ধ ধমনী খুলব কিভাবে?

যাই করি না কেন ১২( বার ) ঘন্টার মধ্যে করতে হবে। এরপরে লাভ নেই বললেই চলে।
হার্ট এ্যাটাকের আধুনিকতম এবং সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা হল সঙ্গে সঙ্গে এ্যানজিওগ্রাম করতে হবে। বন্ধ ধমনী বিশেষভাবে তৈরী বেলুন ও রিং (Stent ) এর সাহায্যে ব্লক অপসারণ করা (জরুরি এ্যানজিওপ্লাস্টি বা primary PCI )। কিন্তু এটি একটি ব্যয়বহল পদ্ধতি এবং এখন পর্যন্ত মূলত রাজধানীকেন্দ্রিক।

অতএব দ্বিতীয় কার্যকর বিকল্প হল জমাট বাঁধা রক্তের দলা গলিয়ে ফেলার ওষুধ প্রয়োগ করা। যদি দেখেন ECG তে STEMI , দ্রুত inj Streptokinase দিয়ে thrombolyse করুন। দায়িত্ব নিয়ে করুন। কোনো মনিটর না হলেও চলবে। বিশ্বাস রাখুন ৬০-৭০% ক্ষেত্রে বন্ধ ধমনী খুলে যাবে। রোগীর জীবন রক্ষা পাবে। হার্টের পাম্পিং ক্ষমতা বজায় থাকবে।
শুধু নীচের কয়েকটি ক্ষেত্রে streptokinase দেয়া যাবে না।
যেমন: ১।চলমান কোন রক্তক্ষরণ থাকলে( মহিলাদের ঋতুস্রাবের মধ্যেও সমস্যা নেই)।
২। গত একমাসের ভেতর কোনো বড় অপারেশন হয়ে থাকলে।
৩। রক্তক্ষরণ থেকে যদি ব্রেন স্ট্রোক হয়ে থাকে।
৪। উপসর্গ থেকে যদি সন্দেহ হয় যে, aortic dissecting aneurysm হতে পারে।

যেসকল চিকিৎসকগণ উপজেলা, জেলা বা অন্য কোনো মফস্বল এলাকায় কর্মরত আছেন তাঁদের এবিষয়ে সচেতন হতে হবে। অনেকসময় অহেতুক আতঙ্কে তাঁরা অনেকে এই জীবনরক্ষাকারী ওষুধটি প্রয়োগ না করে রোগীকে অনিশ্চিত অবস্থায় ফেলে দেন। মাত্র তিন হাজার টাকা দামের এই ওষুধটি সরকারী হাসপাতালে মজুদ থাকে। যদি নাও থাকে তাহলে তিন হাজার টাকা খরচ করার সামর্থ বেশিরভাগ মানুষের আছে। তাই জুনিয়র ডাক্তারদের বলব তাঁরা যেন নির্দ্বিধায় streptokinase ব্যবহার করেন। গরীব মানুষের হার্ট এ্যাটাকের এটিই হল মহৌষধ।

প্রাথমিক পর্যায় পার হলে এবং Anterior MI হলে ACEI বা ARB, Carvedilol বা Bisoprolol এবং ৫ থেকে ৮ দিন LMWH (Clexane) দিনে দু’বার দিতে হবে। এসব ওষুধে হার্ট ফেইল্যুর এবং রক্তনালী পুনরায় বন্ধ হবার ঝুঁকি কমে আসে।

হাসপাতাল থেকে ছুটি এবং পুনর্বাসন:

সাধারণত ৫ থেকে ৮ দিনের মাথায় streptokinase পাওয়া রোগীদের ছুটি দেয়া যায়। হাসপাতালে থাকা অবস্থায়ই দ্বিতীয় দিন থেকে রোগীকে মবিলাইজ করার চেষ্টা করতে হবে। নরম খাদ্য থেকে স্বাভাবিক খাদ্য দিতে হবে।প্রতিদিন কুসুমসহ একটি ডিম দেয়া যেতে পারে। গরীব মানুষের খাদ্যতালিকায় অতিরিক্ত কড়াকড়ি আরোপ করা অনুচিত। তবে ধূমপান চিরতরে ত্যাগ করতে হবে। একমাস ভারী কাজ নিষেধ করতে হবে। ডায়াবেটিস থাকলে কাছাকাছি ডায়াবেটিক সমিতির সদস্য হয়ে স্বল্প খরচে সঠিক চিকিৎসা নিতে হবে। একমাস পার হলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধের ডোজ মাত্রা ঠিক করে নিতে হবে।গরীব মানুষের প্রাইভেট হাসপাতালে আসবার দরকার নেই। একজন প্রশিক্ষিত দক্ষ দায়িত্ববান সরকারী চিকিৎসকের পরামর্শই যথেষ্ট। ঘরবাড়ি, গরুছাগল, ঘটিবাটি বিক্রি করে পরিবারকে পথে বসাবার চিকিৎসার দরকার নেই।

সারাজীবনের ওষুধ:

১। tab Lopirel Plus দিনে ১ বার খাবার পর ১ বৎসর।
তারপর শুধু Tab Ecosprin 75 mg রাতে খাবার পর চলতে থাকবে।
২। tab Atova 40 mg রাতে খাবার আগে ১ বৎসর , তারপরে 20 mg দৈনিক চলতে থাকবে।
৩। এছাড়া beta blocker, ACEI/ARB, হার্ট এ্যাটাকের ধরণ ও পাম্পিং ক্ষমতা (LVEF) অনুযায়ী চিকিৎসক ঠিক করে দিবেন।

বিনা চিকিৎসায় কারো মৃত্যু নয়:

জন্মের সাথে মৃত্যুর অনিবার্যতা চলে আসে। কিন্তু আধুনিক বিশ্বে হার্ট এ্যাটাকে কেউ বিনা চিকিৎসায় বা ভুল চিকিৎসায় মারা যাওয়া উচিত না। রাষ্ট্রের এটি নিশ্চিত করা সাংবিধানিক দায়িত্ব ।দেশে ব্যয়বহুল আধুনিকতম চিকিৎসার পাশাপাশি স্বল্প খরচে আধুনিক টেকসই চিকিৎসাও রয়েছে। দরকার রোগী ও চিকিৎসকদের সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ। সরকারের দায়িত্ব স্বল্প খরচের টেকসই চিকিৎসাকে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া। আর সবাইকে সচেতন করবার জন্য সবধরণের গণমাধ্যমেরও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top