চামড়া শিল্প : সিন্ডিকেট উপাখ্যান

বাংলাদেশের তৃতীয় প্রধান গুরুত্বপূর্ণ রফতানি পণ্য কাঁচা চামড়ার বাজার আজ ধ্বংসের পথে। বিশ্ববাজারে ২০১২ সাল পর্যন্ত দেশীয় এই পণ্য প্রতাপের সাথে মাঠ অধিকার করে রেখেছিল। কিন্তু ২০১৩ সালে হঠাৎ করে রফতানিমুখী চামড়া ব্যবসায়ে ধস নামে। দুই-তিন হাজার টাকার একেকটি চামড়ার দাম মুহূর্তের মধ্যে মাত্র এক হাজারের নিচে নেমে আসে। বর্তমানে গরুর চামড়া বিক্রি হচ্ছে প্রতিটি ৫০০ টাকার নিচে।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৩ সালে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ছিল ৮৫-৯০ টাকা। পরের বছর ৭০-৭৫ টাকা এবং ২০১৫ সালে দাম কমিয়ে করা হয় মাত্র ৫০-৫৫ টাকা। পরের বছর দাম একই থাকে। কিন্তু ২০১৭ সালে এর দাম সর্ব নিম্ন ৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়, যা আজ অবধি অব্যাহত আছে।
গত ছয় বছরে চামড়ার অব্যাহতভাবে দাম কমার রেকর্ড এবারো বজায় থাকবে বলে বিশ্বাস করেন এ সংশ্লিষ্ট মহল। তাদের মতে, গত বছরের সংগ্রহ করা চামড়া আজো সম্পূর্ণরূপে বিক্রি কিংবা রফতানি করা সম্ভব হয়নি। ফলে এবারের ঈদে বিরাট শঙ্কা রয়েছে চামড়া শিল্পে।

চূড়ান্তভাবে চামড়া সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে ৫৫-৫৬টি প্রতিষ্ঠানে (ট্যানারি)। তাদের রয়েছে নিজস্ব সমিতি, যাকে অনেকে বলেন- ‘সিন্ডিকেট হাউজ’। এর দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা দীর্ঘদিন থেকে বলে আসছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে এর দাম পড়ে যাচ্ছে এবং রফতানি বাজার সঙ্কুুচিত হয়ে আসছে। তাই সব সময় আমাদের দেশের চামড়া অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে।

এ সব বিষয়কে দাঁড় করিয়ে তারা (বিটিএ) এর ক্রয়মূল্য অনির্ধারিত রাখতে চান। এ কাজে তাদের সার্বিক সহযোগিতা করে যাচ্ছে সরকার। কিন্তু বিবেচনা করা উচিত, চামড়া দিয়ে যেসব পণ্য তৈরি করা হয়, তার প্রত্যেকটির মূল্য প্রতি বছর বেড়েই চলছে। বিশেষ করে, জুতা ও চামড়ার ব্যাগ, বেল্ট ও জ্যাকেটের দাম বর্তমানে আকাশচুম্বী। একজোড়া চামড়ার জুতার দাম ছয় বছর আগে সাত-আট শ’ ছিল, তা বেড়ে বর্তমানে দুই হাজার টাকা ছুঁই ছুঁই। তাহলে চামড়ার দাম কমবে কেন? গবেষকেরা বলছেন, কাঁচামালের সাথে তৈরী পণ্যের দাম নির্ধারণে একটু পার্থক্য থাকবে। কিন্তু সেটা যৌক্তিক হচ্ছে কি না, এ দেশে সে বিষয়ে নজরদারির কেউ নেই।

সরকারি সূত্র মতে, ২০১৬ সালে দেশে সব ধরনের পশু কোরবানি হয়েছে এক কোটি তিন লাখ, ২০১৭ সালে এক কোটি পাঁচ লাখ এবং ২০১৮ সালে প্রায় এক কোটি ১০ লাখ। সে অনুযায়ী, শতকরা এবার পাঁচ ভাগ কোরবানি বেশি হলেও এক কোটি ১৫ লাখ পশু ধরে নিতে হয়। তার মধ্যে গরু কোরবানি কোনোভাবেই ৪০ লাখের বেশি হবে না। বর্তমানে দেশ থেকেই ৩০ লাখ গরু জোগান দেয়া সম্ভব।

ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, বছরে সারা দেশ থেকে ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৬৪.৮৩ শতাংশ গরুর, ৩১.৮২ শতাংশ ছাগলের, ২.২৫ শতাংশ মহিষের এবং ১.২ শতাংশ ভেড়ার চামড়া। এই চামড়ার বেশির ভাগ সংগ্রহ করা হয় কোরবানির ঈদের সময়।
একসময় দেশীয় চামড়ার বড় ক্রেতা ছিল কোরিয়া, বর্তমানে চীন। সেই চীন চামড়া পাঠায় আমেরিকায়। তারা চীন থেকে চামড়া আমদানির ওপর নতুন করে কর বসায়। এ জন্য চীন আমাদের কাছ থেকে নেয়া চামড়ার দাম কিছুটা কমিয়েছে। প্রশ্ন হলোÑ কত কমিয়েছে? চামড়াকে আমরা যেহেতু পরিপূর্ণ প্রক্রিয়াজাতকরণ করতে পারি, তা হলে আমরা কেন যুক্তরাষ্ট্রের বাজার সরাসরি ধরছি না? তাছাড়া আমাদের নিজেদেরও প্রচুর প্রক্রিয়াজাত চামড়ার চাহিদা রয়েছে। তাহলে হঠাৎ করে গুরুত্বপূর্ণ এই পণ্যটির দাম কমল কেন? কোন যুক্তিতে?

চামড়ার ব্যবসার সাথে জড়িত ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা গত কয়েক বছর লোকসান দিয়ে যাচ্ছেন, শুধু তা নয়, তারা বিভিন্ন হয়রানির শিকারও হচ্ছেন। ট্যানারিতে চামড়া যাওয়ার আগে ঢাকার পোস্তগোলা ও সাভারে কাঁচা চামড়ার বড় আড়ৎ বসে। সেখানে তারা পণ্যটি নিয়ে আসার পর বিভিন্ন অজুুহাতে বিক্রি করতে বিলম্ব ঘটে। এই সুযোগে আড়ৎদার কিংবা ট্যানারি মালিকেরা তাদের লোকসান গুনতে বাধ্য করেন।

চামড়া শিল্প খাতে এই যে ‘নাটকীয়তা’, তার শেষ কি হবে না? কোরবানির ঈদে যেসব পশু জবাই হয়, তার চামড়া বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ গরিবদের মধ্যে সদকা হিসেবে বিলিয়ে দেয়ার দায়িত্ব প্রত্যেক কোরবানদাতার। এ দেশের মানুষ স্বাভাবিকভাবেই ধর্মপরায়ণ। ইসলাম ধর্মে বারবার তাগাদা দেয়া হয়েছে, যেন গরিবের হক নষ্ট না করা হয়। কিন্তু ৫৫-৫৬ জন মানুষের সিন্ডিকেটের হাতে দেশের সমগ্র চামড়া শিল্প গত ছয় বছর কুক্ষিগত। এদের কারণে দরিদ্র জনগণ তাদের ন্যায্য হক বা অধিকার থেকে বঞ্চিত।
ভারতের মতো প্রতিবেশী দেশে প্রতি বর্গফুট কাঁচা চামড়ার দাম ৮০-১০০ টাকা হলেও এ দেশে মাত্র ২৫-৩০ টাকা। এই ব্যবধান কমিয়ে আনতে না পারলে সে দেশে পাচার কোনোভাবেই রোধ করা যাবে না। সব কিছু বিবেচনা করলে দেখা যায়, ভারতের সাথে আমাদের প্রতি পিস চামড়ার মূল্যে পার্থক্য প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা।
আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের চামড়ার চাহিদা বেশি। কেননা, এ দেশের প্রতিটি গরু কিংবা পশু জবাই করার পর চামড়া সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু ভারতে চামড়ার বিশাল একটি অংশ সংগ্রহ করা হয় মৃত গরু থেকে। এতে করে চামড়ার মান খারাপ হয়ে থাকে। তার পরও চামড়ার মূল্য আমাদের চেয়ে বেশি। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কম হলে ভারত বেশি দামে চামড়া ক্রয় করে কিভাবে?

অনেক ট্যানারি মালিক অর্থ সঙ্কটের কথা বলে থাকেন। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যায়, সরকারি চার ব্যাংক এ খাতে ৬০০ কোটি এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলো ৪০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে থাকে। তা ছাড়া মওসুমি ব্যবসায়ীরা এক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন। এত টাকার জোগানের পরও অর্থ সঙ্কট থাকার কোনো কারণ থাকতে পারে না। সত্যিকার অর্থে, সিন্ডিকেট ইচ্ছে করেই এ ধরনের সঙ্কট সৃষ্টি করে নিজ স্বার্থে।

দুস্থ মানুষগুলো আমাদের সম্পদের ওপর ন্যায়সঙ্গত অধিকার রাখে। আমরা যারা কোরবানি দিয়ে কম দামে চামড়া বিক্রি করি, তারা কি গরিবদের হক নষ্ট করছি না? অনেকেই বলবেন, বিক্রিমূল্য যা পেয়েছি তা বিলিয়ে দিয়েছি। কিন্তু মনে রাখা চাই, সিন্ডিকেটের ন্যায় কার্যক্রমের প্রতিবাদ না করে, কম দামে চামড়া বিক্রি করা আর গরিবদের হক নষ্ট করা একই সূত্রে গাঁথা। তাই সবাই মিলে অবিলম্বে এর প্রতিকার করতে হবে। তাহলেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সুবিচার।
লেখক : গ্রন্থকার

Share this post

scroll to top