ঢাকা মেডিক্যালে সিন্ডিকেটে চলছে লাশ আটকের বাণিজ্য

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু হয় গাজীপুরের শ্রীপুরের নিরব (১৮) নামে এক কিশোরের। স্বাভাবিকভাবে ময়নাতদন্তের জন্য তার লাশ পাঠানো হাসপাতালের মর্গে। শোকে স্তব্ধ পরিবারের সদস্যরা সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে মর্গ থেকে লাশটি নিতে চাইলে শুরু হয় বিপত্তি। লাশটি নিতে বাড়তি টাকা দিতে হবে। হাসপাতালের কয়েকজন কর্মচারী মোটা অঙ্কের টাকাও দাবি করে বসেন নিহতের স্বজনদের কাছে। টাকা ছাড়া লাশ মর্গ থেকে বাইরে বের হবে না বলেও হুমকি দেন তারা। একে তো প্রিয়জন হারানোর শোক, তার ওপর লাশ না দেয়া নিয়ে চরম ঝামেলায় পড়ে যান তারা। শেষে ৩ হাজার টাকা দিয়ে লাশটি ছাড়িয়ে নিয়ে যান নিরবের পরিবার। ঘটনাটি চলতি মাসের ৬ তারিখের। একই মাসের ৮ তারিখে ময়মনসিংহে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত রাশিদা (৪৮) পরিবারের কাছ থেকে নেয়া হয় ২ হাজার ৮০০ টাকা।
অভিযোগ রয়েছে, এভাবেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কয়েকজন কর্মচারী লাশ জিম্মি করে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। আর এ টাকার ভাগ শুধু ওই কর্মচারীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। বরং তা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চলে যাচ্ছে ঊর্ধ্বতন প্রশাসনিক কর্মকর্তাদেরও পকেটে। ভুক্তভোগীদের পাশাপাশি খোদ মেডিক্যালে কর্মরত বেশ কিছু কর্মচারীই এমন অভিযোগ তুলেছেন। তৃতীয় শ্রেণীর একজন কর্মচারী বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঠিক হলে, আমাদের মতো কর্মচারীদের ঠিক হতে সময় লাগবে মাত্র এক ঘণ্টা। আর ঊর্ধ্বতনরাই যদি ঠিক না হন, তাহলে সৎ কর্মচারীটিও সহজেই অসৎ হয়ে ওঠেন।’ তারা বলছেন, ঢাকা মেডিক্যালে লাশ জিম্মি করে বাণিজ্য নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি সেই বাণিজ্যের টাকার পরিমাণ কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে; যা মেটানো একটি মধ্যবিত্ত বা গরিব শোকসন্তপ্ত পরিবারের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তার পরও স্বজনের লাশ নিয়ে বাড়ি ফেরার তাগিদ থাকায় নানা দেন-দরবার করে টাকার অঙ্ক কিছুটা কমিয়ে পরিশোধ করেন তারা।

সূত্র মতে, কয়েক বছর আগেও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে লাশ ছাড়াতে সব আনুষ্ঠানিকতার পরও কর্মচারী নেতাদের হাতে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা গুঁজে দিতে হতো। তা না হলে লাশ মর্গ থেকে বের করতে দেয়া হতো না। এখনো প্রায় সে রকমই রয়েছে। তবে পরিবর্তন হয়েছে টাকার অঙ্ক ও আদায়ের ধরনের ক্ষেত্রে। বর্তমানে প্রতিটি লাশের ক্ষেত্রে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা করে আদায় করা হচ্ছে। আর টাকা চাওয়া হচ্ছে অনেকটা সন্ত্রাসী কায়দায়। এই টাকা না দিলে লাশ আটকে রাখার নানা ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে নিহতের স্বজনদের।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই সূত্র আরো জানায়, সম্প্রতি ওয়ার্ড মাস্টার রিয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বে চলছে এই লাশের জিম্মি বাণিজ্য। রিয়াজের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে রাসেলসহ আরো কয়েকজন। তবে সহযোগীরা কেউ হাসপাতালের বেতনভুক্ত সরকারি কর্মচারী নয়। তারা রিয়াজের নিয়োগ দেয়া বহিরাগত কর্মচারী। এদের কাজই হলো লাশ ও রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়া। কারণ এসব কর্মচারী হাসপাতাল থেকে কোনো বেতনভাতা পান না। রোগী ও লাশের স্বজনদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া টাকাই তাদের আয়ের উৎস। সূত্র মতে, হাতিয়ে নেয়া টাকার বড় একটি অংশ নিয়ে যান ওই বহিরাগতদের নিয়োগ দেয়া ওয়ার্ড মাস্টার। সেখানে থেকে আবার একটি অংশ চলে যায় হাসপাতালের প্রশাসনিক কমকর্তাদের কাছে।

কারণ এই প্রশাসক কর্মকর্তারা যখন যাকে নেতা হিসেবে বসাবেন তিনি চালাবেন অবৈধ আয়ের চাবিকাঠি। বর্তমানে মর্গসহ কয়েকটি সেক্টরে সেই চাবিকাঠি নাড়ছেন ওয়ার্ড মাস্টার রিয়াজ। আবার কয়েক বছর পর হয়তো ওই আসনে বসবেন অন্য কেউ। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ওয়ার্ড মাস্টার রিয়াজের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি মোবাইলে নয়া দিগন্তকে বলেন, তিনি বর্তমানে প্রশাসনিক ব্লকে কাজ করেন। সেখানে এ ধরনের অবৈধ কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। তার বিরুদ্ধে করা অভিযোগ মিথ্যা বলেও দাবি করেন তিনি। সূত্রঃ নয়া দিগন্ত

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top