পাবনার ১৬ নদ-নদীতে জীবিকাসন্ধানী ২৫ হাজার মানুষ বেকার

পাবনার ১৬টি নদ-নদী মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। নদীগুলোর প্রায় ৫০০ কিলোমিটার নৌপথ ক্রমাগত পলি পড়ে ভরাট হয়ে নৌচলাচল বন্ধ হয়েছে। ফলে ব্যবসায়ীরা পণ্য পরিবহনে সড়কপথে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। এতে পণ্য পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে হতাশা। এ ছাড়া সেচকার্যক্রম মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। একসময় এ অঞ্চলের নদ-নদীতে জীবিকার সন্ধানে ঘুরে বেড়াত প্রায় ২৫ হাজার মানুষ। তাদের অনেকেই বেকার হয়ে বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন।
জানা যায়, ১৯৭০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বিভিন্ন নৌরুটে লঞ্চ ও নৌকা চলাচল করত। এখন জেলার নদীপথ বছরব্যাপী সচল থাকে না। নাব্যতা ও পরিবহনব্যবস্থার উন্নয়ন সম্পর্কে সুচিন্তিত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সরকারিপর্যায়ে জেলার নদীগুলো সম্পর্কে উদাসীন মনোভাব পোষণের কারণে আজ বিপর্যস্ত নৌপথ। প্রায় আট বছর হয়ে গেল কাজীরহাট ঘাটে ফেরি ভিড়ে না। পন্টুন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। বেড়ায় নৌবন্দর পরিকল্পনা আংশিক বাস্তবায়নের পর পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
নদীপথে যাতায়াত আগের মতোই এখনো সুলভ। প্রতি লিটার জ্বালানিতে এক কিলোমিটার নৌপথে ২১৭ টন মালামাল পরিবহন করা যায়। অথচ সড়কপথে ডিজেল চালিত ট্রাকে এক লিটার জ্বালানিতে এক টন মালামাল এক কিলোমিটার বহন করা যায়। নিয়মিত নদী ড্রেজিং না করায় নৌপথ কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। জেলায় সারা বছর কতটুকু নৌপথ চালু থাকে তারও জরিপ করা হয় না। ১২ মাস পানি থাকে এমন নদী পদ্মা ও যমুনাতে নাব্যতা সঙ্কটে বিশাল চর জেগে ওঠায় ঝুঁকি নিয়ে চলছে মালবাহী জাহাজ।
পাবনা জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানায় পদ্মা নদীর ৭৫ কিলোমিটার, পূর্ব দিকে যমুনা নদীর ২০ কিলোমিটার, উত্তর দিকে হুড়াসাগর নদের আট কিলোমিটার এবং বড়াল নদীর ২৫ কিলোমিটার নদীপথ কোনো মতে টিকে আছে। সামান্য নৌপথ রয়েছে গুমানী নদীতে। রতœাই, আত্রাই, সুতিখালী, চিকনাই, চন্দ্রাবতী, কাগেশ্বরী, বাদাই ও ইছামতি নদীতে বর্ষাকালে মাছ চাষ হয়। তবে শুষ্ক মওসুমে বিভিন্ন রকম ফসলের আবাদ হয়। জেলা প্রশাসন এসব নদী ইজারা দিচ্ছে। বিলুপ্ত হয়ে গেছে রুকনাই, বারনাই, ট্যাপাগাড়ী, গোহালা, শালিকা, শুঁটকিদহ ও ভাঙ্গুড়ার ইছামতি নদী। ইছামতি নদীতে ৫০ কিলোমিটার নৌপথ ছিল। চিকনাই ৩৮ কিলোমিটার ও আত্রাই ৩০ কিলোমিটার। এখন এসব নৌপথ বন্ধ হয়ে গেছে।
ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া ও চাটমোহর উপজেলা মিলে বড়াল নদী রয়েছে মাত্র ২৫ কিলোমিটার। বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে পানি থাকে না। এ নদীর গভীরতা বর্তমানে তিন মিটার দাঁড়িয়েছে। চার মাসও নৌকা চলে না। গোমানী নদীর নাব্যতা থাকে না পাঁচটি ঋতুতে। বাঘাবাড়ীর কাছে বড়াল ও করতোয়ার মিলিত প্রবাহ হুড়াসাগর নদ নামে পূর্ব দিকে এগিয়ে গেছে। বড়াল নদীপথে মিল্কভিটার সদস্যরা দুধ সরবরাহ করে থাকেন; কিন্তু বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে নৌপথ অচল হয়ে পড়ায় তরল দুধ সরবরাহে তাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। শুষ্ক মওসুমে গোহালা নদীকে মধ্যবর্তী একটি চর বিভক্ত করে রাখে; বিন্তু বর্ষাকালে এই চর তলিয়ে গেলে নদী তখন বিভক্ত থাকে না। একত্র হয়ে যায়। তখন নৌযান যাতায়াত বাড়ে।
বর্ষাকালে পাবনার পাট, মাছ, গুড়, গবাদিপশুসহ বিভিন্ন পণ্য এখনো ইঞ্জিনচালিত নৌকায় একমাত্র বেড়া থেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। কিন্তু অভ্যন্তরীণ নদীপথের নাব্যতা রক্ষা ও উন্নয়নে কাজীরহাট ঘাট, বাঘাবাড়ীর ভাটিতে হুড়াসাগর ও যমুনা নদী ছাড়া আর কোথাও ড্রেজিং করা হয় না। বর্ষাকাল ছাড়া অন্যান্য ঋতুতে নৌপথ কমে যাওয়ায় গুরুত্ব কমে গেছে নৌযানের।
যমুনা নদী জেলার পূর্ব প্রান্তে ৮০ মাইল সীমান্ত রচনা করে মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলাকে আলাদা করেছে। বর্তমানে অগ্রহায়ণ মাসে যমুনায় বিশাল বিশাল চর ও ডুবোচর জেগে উঠেছে। এ নদীতে ১২ মাস নৌযান চলাচল করতে পারে; কিন্তু শুষ্ক মওসুমে বিঘœ ঘটে। নদীতে নাব্যতা থাকে না বলে স্থানে স্থানে ড্রেজিং করে নৌপথ চালু রাখা হয়। বছরের সব সময় এ নদী দিয়ে বড় মালবাহী জাহাজ, লঞ্চ ও নৌকা চলাচল করতে পারে না। যমুনা নদী দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ। ইছামতির ৩০ কিলোমিটার পথ পরিত্যক্ত হয়ে আছে। আগে বেড়া থেকে ভাঙ্গুড়ার বড়াল ব্রিজ পর্যন্ত লঞ্চ সার্ভিস চালু ছিল। সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। টিকে আছে কেবল কাজীরহাট-পাটুরিয়া। জেলার বড়াল, গুমানী ও চন্দ্রাবতীতে বর্ষাকালে মালবাহী নৌকা চলাচল করে; কিন্তু অন্যান্য সময়ে নদীতে পানি থাকে না। ভরাট হয়ে গেছে আত্রাই নদী।
পদ্মা নদী পাবনায় প্রায় ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণ সীমান্তজুড়ে প্রবাহিত। এ নদীতে আগে স্টিমার, মালবাহী বড় বড় নৌকা যাতায়াত করত। পানির স্তর কমে যাওয়ায় এ নদীতে লঞ্চ ও বড় বড় নৌকা চলাচল করে না। জেলার বিরাট এলাকাজুড়ে বছরের বেশির ভাগ সময় পানিমগ্ন থাকত। বর্ষাকালে স্বভাবতই প্রায় সব রাস্তাঘাট ডুবে যেত। কয়েক বছর আগেও নৌপথই সামগ্রিক যোগাযোগব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। সড়কপথের তুলনায় নৌপথই জনপ্রিয় ছিল। পদ্মার শাখা নদী ও বিলের ওপর দিয়ে পণ্যবাহী নৌকা চলাচল করত। এখন কেবল বর্ষাকালে চাটমোহর, ফরিদপুর ও ভাঙ্গুড়া এলাকায় পণ্যবাহী পানসি, কোষা ও ডিঙ্গি নৌকা চলাচল করে।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top