ভাসানচর কি প্রস্তুত : রোহিঙ্গাদের নেয়া হবে শিগগিরই

২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসতে শুরু করে সেখানকার রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গারা। দেশটির সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি স্থানীয়দের অত্যাচার থেকে প্রাণে বাঁচার জন্য তারা দলে দলে বাংলাদেশের দিকে ছুটে আসে।

বাংলাদেশের হিসেবে শুধু এই দফাতেই দেশে প্রবেশ করেছে প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা। জাতিসঙ্ঘ অবশ্য এ সংখ্যাটিকে সাড়ে সাত লাখ বলে উল্লেখ করছে। ঢাকার পক্ষ থেকে বারবার রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত নিয়ে যাওয়ার দাবি করা হলেও তাতে এই দেড় বছরে কোনো অগ্রগতি হয়নি।

ফলে সরকার রোহিঙ্গাদেরকে কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে সরিয়ে নোয়াখালির ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সে হিসেবে ভাসানচরকে এক লাখ রোহিঙ্গার বসবাসের উপযোগী করা হচ্ছে। প্রস্তুতি চলছে রোহিঙ্গাদের শিগগিরই সেখানে নিয়ে যাওয়ার। বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের নোয়াখালীর ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতির কাজ শেষের পথে। তারা আশা করছেন, আগামী দেড় মাসের মধ্যে সেখানে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, আশ্রয় কেন্দ্রসহ সব ধরনের অবকাঠামোর নির্মাণের কাজ শেষ হয়ে যাবে।

বঙ্গোপসাগরে ১৩ হাজার একরের এই দ্বীপটির তিন হাজার একর জায়গার চারপাশে বাঁধ নির্মাণ করে সেখানে রোহিঙ্গাদের জন্যে বসতি গড়ে তোলা হচ্ছে। লাগানো হয়েছে নারকেল সুপারিসহ বহু গাছপালাও। এসব অবকাঠামো নির্মাণে উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন আহমেদ মুক্তা। তিনি জানান, ভাসানচরের এই প্রকল্পটির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে।

রোহিঙ্গাদের জন্য কী কী নির্মাণ করা হচ্ছে?
প্রকল্পে যতো রাস্তা ও অবকাঠামো আছে সেগুলোর নির্মাণ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে বলে জানান আহমেদ মুক্তা। তিনি বলেন, নকশা অনুযায়ী ১,৪৪০টি ঘর বানানো হয়েছে, যার প্রতিটি ঘরে ১৬টি করে পরিবারের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পরিবারে যদি চারজন করে সদস্য হয় তাহলে তাদের আলাদা একটা কক্ষ দেয়া হবে এবং তাদের জন্য আলাদা রান্নাবান্না ও টয়লেটের সুবিধাও রাখা হয়েছে।

বন্যা বা জলোচ্ছ্বাসের পানি ঠেকাতে বাড়িগুলো মাটি থেকে চার ফুট উঁচু করে বানানো হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন । সব মিলিয়ে ঘরগুলোর কাজ প্রায় ৮৫% শেষ হয়েছে। আহমেদ মুক্তা আশা করেন, প্রকল্পের যে সময়সীমা বেধে দেয়া হয়েছে, তার আগেই অর্থাৎ এক থেকে দেড় মাসের মধ্যেই পুরো প্রকল্পের শতভাগ কাজ শেষ হয়ে যাবে।”

পরিবেশ-বান্ধব প্রকল্প
এই প্রকল্পটির আরেকটি লক্ষ্যণীয় বিষয় হল এখানে সব ধরনের সেবা দেয়া হচ্ছে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি মাথায় রেখে। যেমন এখানে মানুষের উচ্ছিষ্ট থেকে বায়োগ্যাস উৎপাদন ও ব্যবহারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সেই গ্যাস দিয়েই চলবে রান্নাবান্না। এছাড়া বিদ্যুতের জন্য সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে। প্রতিটি স্থানে পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহের জন্য তিনটি বিকল্প ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সেগুলো হল, ভূমি থেকে ৭২০ ফুট গভীর থেকে পানি উত্তোলন, বৃষ্টির পানি ধরে রাখা এবং পর্যাপ্ত পুকুর।

এখানকার প্রত্যেক বাড়ির টিনের চাল থেকে থেকে পড়া বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করা হবে যেন মানুষ তাদের দৈনন্দিন কাজে সেই পানি ব্যবহার করতে পারে। এছাড়া প্রতিটা ক্লাস্টারে ১২০টা পুকুর তৈরি করা হয়েছে।

দুর্যোগ মোকাবিলায় কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে?
তবে রোহিঙ্গাসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার মনে বড় ধরনের আশঙ্কা রয়েছে যে এই অঞ্চলটিতে বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে।

এ ব্যাপারে আহমেদ মুক্তা বলেন, যে কোন দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতি থেকে মানুষকে রক্ষায় ১২০টি সাইক্লোন সেন্টার বানানো হয়েছে। এগুলোর একেকটি চার তলা ভবন। যার নীচতলা পুরো খালি থাকবে এবং প্রতিটি শিবিরে এক হাজার মানুষ জরুরি অবস্থায় আশ্রয় নিতে পারবে।

তাছাড়া আশ্রয় কেন্দ্রগুলোও ভূমি থেকে ৪ ফুট উঁচু করে বানানো হয়েছে। সব মিলিয়ে ভূমি থেকে ভবনটির নীচতলার ছাদ ১৪ ফুট ওপরে। অর্থাৎ যদি কোনো জলোচ্ছ্বাস ১৪ ফুটের ওপরে না আসে তাহলে কেউই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।

জলোচ্ছ্বাস বা জোয়ারের সময় আগে ভাসানচরের অনেকাংশই ডুবে যেতো। সেটা থেকে পরিত্রাণেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানান তিনি। তিনি বলেন, এ প্রকল্প শুরু করার আগে ভাসানচর বড় ঢেউ বা বন্যায় দুই থেকে তিন ফুট পানির নীচে চলে যেতো। কিন্তু এখন এমনটা হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। কেননা এই প্রকল্পের আওতায় ১৩ ফুট দীর্ঘ, ৯ ফুটের এমব্যাঙ্কমেন্ট বানানো হয়েছে বা পাড় বাঁধানো হয়েছে। যে অঞ্চলে এই মানুষগুলোর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে সেখানে তাই পানি প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই।”

এছাড়া এতোগুলো মানুষের শিক্ষা, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সার্বিক সেবা সরবরাহের কথাও তিনি জানান। মূলত, যে ১২০টি সাইক্লোন সেন্টার বানানো হয়েছে তার মধ্যে কয়েকটি বিকল্প কাজে ব্যবহারযোগ্য সাইক্লোন সেন্টার আছে। এ সেন্টারগুলো বাড়তি সেবার জন্য যেমন, প্রশাসন, পুলিশ, হাসপাতাল, কমিউনিটি ক্লিনিক, স্কুল, কলেজ ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করা হবে।

স্থানান্তর কবে নাগাদ
কবে নাগাদ এবং কতজন রোহিঙ্গাদের ভাসানচরের এ প্রকল্পে স্থানান্তর করা হবে, সে বিষয়ে আহমেদ মুক্তা বলেন, আমরা যে নির্দেশনা পেয়েছি যে তাদেরকে খুব শিগগিরই সেখানে নেয়া হবে। তার জন্য আমাদের দিক থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি প্রায় শেষের পর্যায়ে আছে।

এছাড়া নৌবাহিনীর একটি ধারণা অনুযায়ী প্রতিদিন ৫০০জন রোহিঙ্গাকে ধাপে ধাপে এখানে আনা হবে। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, তাদেরকে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম-ভাসানচর এই রুটে আনা হবে। তাই একসঙ্গে সবাইকে স্থানান্তর সম্ভব নয়। তাই বলা যেতে পারে যে এক লাখ রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর করতে দুই থেকে তিন মাস সময় লেগে যেতে পারে।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top