যে কারণে শ্রমিক অসন্তোষ

দেশের সম্ভাবনাময় তৈরীপোশাক শিল্পখাতে চলমান শ্রমিক অসন্তোষের মূলে কাজ করছে নতুন মজুরি কাঠামো। আগের চেয়ে ৫১ শতাংশ মজুরি বাড়িয়ে করা নতুন কাঠামো কোনোভাবেই মানতে চান না শ্রমিকরা। আবার বাহ্যিক দৃষ্টিতে মেনে নিলেও নতুন কাঠামো নিয়ে আপত্তি রয়েছে মালিক পক্ষেরও।

ফলে ঘোষিত কাঠামো বাস্তবায়ন নিয়েও সংশয়ে রয়েছেন শ্রমিকরা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আগামী দিনগুলোতে অসন্তোষ-বিক্ষোভ আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও বরাবরের মতোই শিল্পমালিকরা এতে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন খুঁজছেন। বিক্ষোভ দমনে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী রয়েছে জবরদস্তিমূলক কৌশলে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ঘোষিত মজুরি কাঠামো নিয়ে শ্রমিকদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভ থাকলেও শ্রমিক সংগঠনগুলোর সাথে সরকারের সমঝোতার ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচনের আগে তারা কোনো জোরদার আন্দোলনে যায়নি। জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কায় তখন পোশাক কারখানা এবং শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকাগুলোর ওপর কড়া নজরদারি আরোপ করে সরকার।

গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য ছিল, নতুন মজুরি কাঠামোর বাস্তবায়ন নিয়ে শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের অবনতি হতে পারে। জাতীয় নির্বাচনের পূর্বমুহূর্তে কোনো ধরনের শ্রমিক অসন্তোষের সৃষ্টি হলে সেটি জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে বলেও আশঙ্কা ছিল গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর। শিল্প পুলিশের পাশাপাশি শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় নজরদারি বাড়ায় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।

নির্বাচন এবং সরকার গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর পরিস্থিতি কিছুটা শিথিল হয়ে আসে এবং মাঠে নামতে থাকেন শ্রমিকরা।

গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু এ প্রসঙ্গে বলেন, নতুন বেতন কাঠামো নিয়ে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। শ্রমিকরা নির্বাচনের আগেই রাস্তায় নেমেছিলেন তাদের যৌক্তিক দাবি নিয়ে। তাদের নির্বাচনের কথা বলে হাতে-পায়ে ধরে আন্দোলন থেকে বিরত রাখা হয়েছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর তাদের বেতন-ভাতা প্রদানের আগেই বেতনবৈষম্যও মেটানোর কথা ছিল। কিন্তু এখন মালিকদের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। এটা খুবই দুঃখজনক।

বিশ্লেষকদের মতে, নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন হয় পয়লা ডিসেম্বর থেকে। সে অনুযায়ী ডিসেম্বরের বেতন পাওয়ার কথা জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। কিন্তু ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ আসার আগেই রাস্তায় নামেন শ্রমিকরা। এর কারণ হিসেবে শ্রমিক নেতাদের বক্তব্য, অনেক কারখানায়ই আগের নিয়মে কিংবা কিছুটা বাড়িয়ে ডিসেম্বরের মজুরির বিল তৈরি করা হচ্ছে বলে তাদের কাছে খবর আছে। তা ছাড়া এমন অনেক কারখানা আছে যেগুলোয় কয়েক মাসের বেতন বকেয়া।

মূলত সেসব কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলনে নেমেছেন বলে জানান তারা। আগামী সপ্তাহের মধ্যে নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়নের মোটামুটি চিত্র পাওয়া যাবে জানিয়ে তারা বলেন, এ সময় শ্রমিক আন্দোলন আরো জোরদার হতে পারে।

এ দিকে নতুন মজুরি কাঠামো নিয়ে মালিকপক্ষ বেশ চাপে আছে জানিয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির সাবেক প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে মজুরি বেড়েছে ৫১ শতাংশ। মনে করেন একটি ফ্যাক্টরির শ্রমিকের মাসিক বেতন বর্তমানে আসে এক কোটি টাকা। নতুন কাঠামো অনুযায়ী ওই মালিককে এখন বেতন দিতে হবে এক কোটি ৫১ লাখ টাকা।

তাহলে কি ঐ ফ্যাক্টরি বিগত দিনে মাসে ৫১ লাখ টাকা হারে লাভ করেছে? অসম্ভব ! তাহলে এই বাড়তি টাকাটা আসবে কোত্থেকে? জায়গা একটাই, বায়ারদের কাছ থেকে ফিনিশড পণ্যের দাম বাড়িয়ে নিতে হবে। অথবা অন্য খরচ কমাতে হবে। যদিও এটা অনেক কঠিন। কারণ এ দেশে গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক সব কিছুরই বিল দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। এমতাবস্থায় আগামী দিনগুলোতে নতুন নতুন কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

তৈরীপোশাক শিল্পের শ্রমিকদের মজুরি সর্বপ্রথম নির্ধারিত হয়েছিল ১৯৮৫ সালে। এটি পোশাক শিল্পবিষয়ক প্রথম মজুরি বোর্ড। এ বোর্ড ঘোষিত শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ছিল ৬২৭ টাকা। পোশাক শ্রমিকদের জন্য দ্বিতীয় মজুরি বোর্ড গঠিত হয় নির্ধারিত পাঁচ বছরের পরিবর্তে ৯ বছর পর, ১৯৯৪ সালে। দ্বিতীয় মজুরি বোর্ড ঘোষিত নিম্নতম মজুরি ছিল ৯৩০ টাকা, যা প্রথম মজুরি বোর্ডের ঘোষিত মজুরির ৪৮ শতাংশের অধিক।

পোশাক শ্রমিকদের জন্য তৃতীয় মজুরি বোর্ড গঠিত হয় নির্ধারিত পাঁচ বছরের পরিবর্তে ১২ বছর পর, ২০০৬ সালে। তৃতীয় মজুরি বোর্ড ঘোষিত নিম্নতম মজুরি ছিল ১৬৬২.৫০ টাকা, যা দ্বিতীয় মজুরি বোর্ডের ঘোষিত মজুরির চেয়ে ৭৮ শতাংশের অধিক। চতুর্থ মজুরি বোর্ডটি নির্ধারিত পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার আগে চার বছরের মাথায় ২০১০ সালে গঠিত হয়।

চতুর্থ মজুরি বোর্ড ঘোষিত সর্বনিম্ন মজুরি ছিল ৩০০০ টাকা, যা তৃতীয় মজুরি বোর্ডের ঘোষিত মজুরির ৮০ শতাংশের অধিক। চতুর্থ মজুরি বোর্ডের মতো পঞ্চম মজুরি বোর্ডটিও পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার আগে তিন বছরের মাথায় ২০১৩ সালে গঠিত হয়েছে। পঞ্চম মজুরি বোর্ড ঘোষিত নিম্নতম মজুরি ছিল ৫৩০০ টাকা, যা চতুর্থ মজুরি বোর্ডের ঘোষিত মজুরির তুলনায় ৭৬ শতাংশের বেশি। আর এবার গঠিত ষষ্ঠ মজুরি বোর্ড আগেও মজুরি ৫১ শতাংশ বাড়িয়ে ৮ হাজার টাকা নির্ধারণ করে।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top